ডেস্ক রিপোর্ট
৮ জুন ২০২৫, ১১:০৬ অপরাহ্ন
অনলাইন সংস্করণ

সিলেটে এবার বন্যায় ম্লান ঈদের আনন্দ

ফাইল ছবি

সিলেটে এবার বন্যায় ম্লান ঈদের আনন্দ। ইতোমধ্যে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন বিভিন্ন উপজেলার হাজার হাজার মানুষ। কেউ কেউ বাস করছেন আশ্রয়কেন্দ্রে আবার অনেকে নিজ বাড়িতে যুদ্ধ করছেন পানির সঙ্গে। বন্যায় ঈদের আনন্দ এবার মাটিতে মিশে গেছে সিলেট জেলার চার উপজেলার কয়েক হাজার মানুষের। প্লাবিত হয়েছে অনেক এলাকা, পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন ১৫ হাজারের বেশি মানুষ।

গত কয়েক দিনের টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সিলেটের ৪ উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত রয়েছে। বৃষ্টি না থাকায় সিলেট নগর থেকে পানি নামলেও সুরমা ও কুশিয়ারার চারটি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে নতুন করে সিলেটের জকিগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, কানাইঘাট, বালাগঞ্জ উপজেলাসহ নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে ডাইক ভেঙে নদীর পানি লোকালয়ে প্রবেশ করেছে। এতে কোনোভাবেই মানুষের আতঙ্ক কাটছে না। ইতোমধ্যে নিম্নাঞ্চলের মানুষ খোঁজ নিয়েছেন নিরাপদ আশ্রয়ের।

সিলেটের চার উপজেলায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন ১৫ হাজার ৬০৭ জন। আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করছেন ৪৩২ জন। জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৫৮২টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ জন্য জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসন কার্যালয়গুলোতে কন্ট্রোলরুম স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া বন্যার্তদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য ইউনিয়ন ভিত্তিক মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। চাল ও শুকনো খাবার খাবার প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিতরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া অসংখ্য স্থানে ডাইক উপচে পানি প্রবেশ করে। এতে প্লাবিত হয় বিভিন্ন গ্রাম, হাটবাজার ও বসতবাড়ি।

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, বন্যার সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য জেলা প্রশাসকের কার্যালয় এবং উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়গুলোতে কন্ট্রোলরুম স্থাপন করা হয়েছে। বন্যার্ত বাসিন্দাদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য ইউনিয়ন ভিত্তিক মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। বন্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে এবং প্রয়োজনীয় ঔষধ পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। দুর্যোগকালীন মজুদকৃত ভাণ্ডার হতে এখন পর্যন্ত শুকনো খাবার ৭০০ বস্তা, জিআর চাল ৩২০ মেট্রিক টন, জিআর নগদ অর্থ ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা, শিশু খাদ্য ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা এবং গোখাদ্য ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে।

বন্যা আক্রান্ত ৪টি উপজেলায় ৬৩ টন চাল, নগদ অর্থ ৫০ হাজার টাকা এবং ১৯৪ প্যাকেট শুকনা খাবার বিতরণ করা হয়েছে। সিলেট জেলায় অব্যাহত ভারী বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের ফলে জেলার অভ্যন্তরীণ নদ-নদীগুলোর পানি ৪টি পয়েন্টে বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত বিয়ানীবাজার হলেও জকিগঞ্জ ও কানাইঘাট উপজেলায় পানি হ্রাস পাচ্ছে। বন্যার সার্বিক পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের সূত্রে জানা গেছে, শুক্রবার বিকেল সাড়ে তিনটার প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট উপজেলায় ৭ সেন্টিমিটার হ্রাস পেয়ে ৪৪ সেন্টিমিটার এবং কুশিয়ারা নদীর পানি জকিগঞ্জ উপজেলায় ৮ সেন্টিমিটার হ্রাস পেয়ে ৬৯ সেন্টিমিটার বিয়ানীবাজার উপজেলায় ৩ সেন্টিমিটার হ্রাস পেয়ে ১৪ সেন্টিমিটার ও ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলায় ৩ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে ৭৫ সেন্টিমিটার বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অন্যান্য নদীসমূহের মধ্যে সারি, ডাউকি ও সারি গোয়াইন নদীর পানি হ্রাস পাচ্ছে।

শুক্রবার (৬ জুন) সিলেটের জকিগঞ্জ ও বিয়ানীবাজার, কানাইঘাট ও কয়েক হাজার মানুষ বন্যার পানিতে জীবনযাপন করছেন।

স্থানীয় এলাকাবাসী জানান, বিগত সপ্তাহের ভারী বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢল এবং কুশিয়ারা নদীর ভাঙনে জকিগঞ্জ উপজেলার ২৫/৩০ গ্রাম প্লাবিত হয়ে যায়। পানিবন্দি হয়ে পড়েন জকিগঞ্জ সদর ইউনিয়ন, খলাছড়া ইউনিয়ন, সুলতানপুর ইউনিয়ন, বীরশ্রী ইউনিয়ন ও কাজলসার ইউনিয়নের হাজারো পরিবার। পবিত্র ঈদুল আজহার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে এমন ভয়াবহ বন্যায় চরম বিপাকে পড়তে হয় বন্যা কবলিত এলাকার মানুষকে। কুশিয়ারা নদীর ভাঙন কবলিত এলাকার পার্শ্ববর্তী গ্রাম সমূহের শতশত পরিবার কোরবানির পশু ক্রয় কিংবা ঈদের প্রস্তুতি নেয়ার সুযোগই পাননি। তাই জকিগঞ্জের এবারের বন্যায় হাজারো পরিবারের ঈদ আনন্দ হারিয়ে গেছে।

জকিগঞ্জ উপজেলার পশ্চিম লোহারমহল গ্রামের গৃহিণী দিলু বেগম জানান, বন্যায় তলিয়ে গেছে বসতঘরসহ যাবতীয় মালামাল। বর্তমানে তিনি ৫ সদস্যের পরিবারকে রান্নাবান্না করে খাওয়ানোর কোনো সুযোগ পাচ্ছেন না। ঈদের আনন্দ বলতে তাদের পরিবারে অবশিষ্ট কিছুই নেই। কোরবানি দেয়া তো দূরের কথা এখন ঘর মেরামত কীভাবে করবেন তা নিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন।

সুবহান মিয়ার সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, আগে আমি খুব কষ্ট করে একটা ঘর তৈরি করে স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে মোটামুটি ভালোভাবে চলছিলাম। কিন্তু বন্যায় আমার সব শেষ হয়ে গেছে। নতুন করে সবকিছু কিনতে হচ্ছে। ঘর তৈরি করতে হচ্ছে। এখন পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারিভাবে কোনো অনুদান পাইনি। আমাদের পরিবারের ঈদ আনন্দ বলতে কিছুই নেই। বন্যার সঙ্গে যুদ্ধ করছি।

নাজমা বেগম বলেন, নদী ভেঙে বসতঘরে পানি ঢুকে গিয়েছিল। গতকাল চেয়ারম্যানসহ এলাকার লোকজন ডাইক বন্ধ করায় ঘর থেকে পানি নেমে গেছে। এখন বসতঘর পরিষ্কার করা এবং জিনিসপত্র শুকানো আমাদের জন্য বড় কাজ হয়ে পড়েছে। আমাদের ঈদ বলতে কিছুই নেই।

আমিন মিয়া বলেন, এমনিতেই আমরা গরিব মানুষ। আমরার ঈদ তো এমনিতেই নেই। তবুও বন্যা না আসলে বাচ্চারা কিছু আনন্দ ফুর্তি করতো, তাও এখন শেষ।

জকিগঞ্জ সদর ইউনিয়নের কুশিয়ারা নদীর তীরবর্তী রারাইগ্রামের বিধবা রহিমা বেগম বলেন, স্বামী মারা গেছেন অনেক আগে। ৪ সন্তান নিয়ে এমনিতেই বেকায়দা রয়েছেন। তারমধ্যে বন্যায় বসতঘর নষ্ট করে দিয়েছে। এখন কীভাবে কি করি তা চিন্তা করে পাচ্ছি না। এইবার ঈদ বলতে আমাদের কোন কিছু আছে বলে মনে হচ্ছে না।

মানিকপুর গ্রামের ভাঙা ডাইকের পানিতে ঘর হারানো জালাল উদ্দিন বলেন, আমাদের ঈদ বলতে কিছু নেই। কুশিয়ারা নদীর ডাইক ভেঙে আমার পুরো ঘর তছনছ করে দিয়েছে। এ ক্ষতি কেটে উঠার কোন উপায় দেখছিনা। ঈদ আমার পরিবারের নেই।

ব্যবসায়ীরা জানান, জকিগঞ্জে এবারের ঈদে কাপড়ের দোকান ও পশুর হাটেও বন্যার প্রভাব পড়েছে। অন্যান্য বছর বিপণি বিতানগুলো সপ্তাহ খানেক আগে ভিড় লেগে থাকলেও শুক্রবার রাত পর্যন্ত উপজেলার একাধিক বাজার ফাঁকা রয়েছে।

জানা যায়, এবারের বন্যায় জকিগঞ্জের কয়েক হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। শতাধিক মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিলেও বর্তমানে পানি কমে পরিস্থিতির সামান্য উন্নতি হলেও বহু মানুষ এখনও আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান করছেন। অনেকের বাড়ি ফেরা নিয়ে এখনও অনিশ্চয়তা রয়েছে। ফলে এসব বানভাসিদের মধ্যে এবার ঈদের আনন্দ নেই।

এ বিষয়ে জকিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, বন্যা কবলিত এলাকায় আমরা দু’দফা ত্রাণ (চাল) বিতরণ করেছি। ঈদের জন্য আলাদাভাবে কোনো বরাদ্দ দেয়া হয়নি। তবে ঈদের দিন সকালে আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থানরতদের মধ্যে খাবার পরিবেশন করা হবে।

সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মোহাম্মদ মাহবুব মুরাদ বলেন, সুরমা-কুশিয়ারায় পানি বাড়ার কারণে কিছু কিছু এলাকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত রয়েছে। বন্যা কবলিত এলাকায় আমাদের ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রয়েছে। আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নাই। প্রশাসন মানুষের পাশে আছে।

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সিলেটে এবার বন্যায় ম্লান ঈদের আনন্দ

ঈদের দ্বিতীয় দিনে গাজায় ২২ ফিলিস্তিনিকে হত্যা

শিল্পাঞ্চল থেকে ৩৩৫ দুষ্কৃতকারী গ্রেপ্তার: আইএসপিআর

আদানির সঙ্গে বিলিয়ন ডলারের চুক্তি বাতিল

জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি খেলে কি মানুষ মোটা হয়?

ভারত-পাকিস্তান মধ্যস্থতা করতে প্রস্তুত বাংলাদেশ: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

প্রধান উপদেষ্টার দেওয়া নির্বাচনের সময় ‘এপ্রিল ফুল’

আনন্দবাজারে ওবায়দুল কাদেরের সাক্ষাৎকার, জানালেন নির্বাচনে অংশগ্রহণের পরিকল্পনা

সরকারি দামেও বিক্রি হচ্ছে না চামড়া

গুম কমিশনের সদস্যদের হুমকি-কাজে বাধা, প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা

১০

ঈদের ফিরতি যাত্রায় সবাইকে মাস্ক পরার অনুরোধ

১১

বিদায়ের আগে সিঙ্গাপুরকে হারিয়ে দেশবাসীকে ঈদ উপহার দিতে চান কাবরেরা

১২

ডিসেম্বরেই নির্বাচন চায় বাসদও

১৩

ভারতে করোনায় একদিনে ৬ জনের মৃত্যু, আক্রান্ত ৩৭৮

১৪

জুলাই ঘোষণাপত্র ও সনদ বাস্তবায়নের পর নির্বাচন হলে প্রত্যাশা পূরণ হতো: আখতার

১৫

একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে অথই সমুদ্রে জাকিরের মা

১৬

আল্লাহর সৃষ্টির বিশালতার কথা ভেবে কেঁদেছিঃ কনক চাঁপা

১৭

ভারতে করোনার আবির্ভাব, দেশের সব বন্দরে সতর্কতা জারি

১৮

নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা কেউ করবেন না: জামায়াতের আমির

১৯

ঢাকায় পৌছালো সিঙ্গাপুর ফুটবল দল

২০