অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত গুম কমিশনের সদস্যদের ব্যক্তিগতভাবে, টেলিফোনে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও নিয়মিতভাবে হুমকি দেওয়া হয়েছে। তবে এসব হুমকি উপেক্ষা করেই কমিশনের সদস্যরা তাদের কাজ অব্যাহত রেখেছেন। হুমকি ছাড়াও কমিশনের কাজে প্রক্রিয়াগতভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে বলেও দ্বিতীয় প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া সংগঠিত অপরাধের প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা করা হয়েছে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে গোপন আটক-কেন্দ্রগুলোর ভেতরে যে প্রমাণ ধ্বংসের পরিকল্পিত প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে, তার বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করেছে অনুসন্ধান কমিশন। নতুন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে নির্যাতন কেন্দ্র ‘হাসপাতাল’ ও ‘ক্লিনিক’ নামে পরিচিত দুটি গোপন কেন্দ্রের কাঠামো গুঁড়িয়ে দেওয়া এবং নির্যাতন যন্ত্রপাতি লুকানোর ভয়ংকর পরিকল্পনার চিত্র।
গত বুধবার (৪ জুন) ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ: অ্য স্ট্রাকচারাল ডায়াগনোসিস অব এনফোর্স ডিজঅ্যাপায়েরেন্স অব বাংলাদেশ’ শিরোনামে গুম কমিশনের এই প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেওয়া হয়। শুক্রবার (৬ জুন) প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে প্রতিবেদনের দুটি পৃথক অধ্যায় গণমাধ্যমে পাঠানো হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কমিশনের সদস্যরা ধারাবাহিকভাবে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভয়ভীতি ও হুমকির মুখে পড়েছেন। ব্যক্তিগতভাবে, টেলিফোনের মাধ্যমে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের হুমকি দেওয়া হয়েছে। তাদের পরিকল্পিত হয়রানি, অপপ্রচার এবং মিথ্যা তথ্য প্রচারের শিকার হতে হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই, র’ ও সিআইএ’র এজেন্ট হওয়া থেকে শুরু করে ধর্মীয় বা রাজনৈতিক উগ্রবাদী হওয়ার অভিযোগও আনা হয়েছে। কিছু সাক্ষাৎকারে অভিযুক্তরা সরাসরি জানিয়েছে যে, তারা কমিশন সদস্যদের পরিবারের ওপর নজরদারি করছে। তবে এসব ভয়ভীতির প্রচেষ্টা কমিশনের কাজের গতি বা দিক পরিবর্তন করতে পারেনি। কমিশনের সদস্যরা এসব উসকানিকে উপেক্ষা করে ভুক্তভোগীদের প্রতি পূর্ণ প্রতিশ্রুতি ও ম্যান্ডেট বজায় রেখে তাদের কাজ অব্যাহত রেখেছেন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ভয়ভীতি প্রদর্শনের বাইরেও কমিশনকে ধারাবাহিকভাবে প্রক্রিয়াগত প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। এক ঘটনায়, একটি গোপন আটক কেন্দ্র যা পরিদর্শন করে আলোকচিত্রসহ প্রমাণ সংগ্রহ করা হয়েছিল, সংশ্লিষ্ট সংস্থা লিখিতভাবে এর অস্তিত্ব অস্বীকার করেছিল। পরে সরাসরি যোগাযোগ ও অখণ্ড প্রমাণ উপস্থাপনের পর সংস্থাটি তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে এবং স্থাপনাটির অস্তিত্ব স্বীকার করে।
কমিশনের সবচেয়ে ‘নিয়মিত প্রক্রিয়াগত সমস্যা’ ছিল অফিসিয়াল চিঠির জবাব সময়মতো পাওয়া। এ প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনেক প্রতিষ্ঠান সংবেদনশীল তথ্য লিখিতভাবে দেওয়া থেকে স্পষ্টভাবেই বিরত থেকেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাধারণ তথ্যের জন্য জবাব পেতে সপ্তাহ বা মাস লেগে গেছে। যেমন, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে পাঠানো একটি চিঠির উত্তর পেতে প্রায় এক মাস সময় লেগেছিল, যদিও চাওয়া তথ্য ইতোমধ্যেই জনসমক্ষে ছিল।
এছাড়া যানবাহনের রেকর্ড, কর্মীদের তালিকা, মোতায়েনের ইতিহাস বা কোনও একটি স্থাপনার দায়িত্বে কে ছিলেন এমন তথ্যে অ্যাকসেস চাওয়া হলে দীর্ঘ নীরবতা, বিলম্ব বা অস্পষ্টতা দেখা গেছে বলেও অভিযোগ করেছে কমিশন। প্রতিবেদনে বলা হয়, এমনকি সাধারণ তথ্য পেতেও একাধিকবার লিখিত ও সরাসরি অনুসন্ধান করতে হয়েছে। কিছু জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা, এমনকি মহাপরিচালক পর্যায়ের ব্যক্তিরাও জানিয়েছেন যে, অন্যান্য সংস্থাগুলো তাদের কমিশনের সঙ্গে সহযোগিতা করতে নিরুৎসাহিত করেছে— যা একটি উদ্বেগজনকভাবে সমন্বিত, তবে শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ, প্রচেষ্টার ইঙ্গিত দেয় যা প্রাতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতা রোধ করতে চেয়েছে।
হারিয়ে গেছে অনেক রেকর্ড
কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সময়ের অগ্রগতিও আমাদের বিপক্ষে কাজ করেছে। আমাদের অনুসন্ধানের আওতাভুক্ত অনেক ঘটনা এক দশকেরও বেশি পুরনো। ফলে গুরুত্বপূর্ণ অফিসিয়াল রেকর্ড, যেমন কল ডিটেইল রেকর্ড (সিডিআর) সংরক্ষিত নেই। সাধারণত টেলিকম কোম্পানিগুলো এসব তথ্য এক থেকে দুই বছর পর্যন্ত সংরক্ষণ করে। একটি ঘটনায়, আমাদের কাছে র্যাবের পোশাক পরিহিত এক সদস্যের একটি ছবি ছিল, যার মোবাইল নম্বর থেকে নিখোঁজ এক ভিকটিম তার পরিবারের সঙ্গে একাধিকবার একটি অজ্ঞাত আটককেন্দ্র থেকে যোগাযোগ করেছিলেন। ছবিটি সেই সময়ে তার ভাইবার প্রোফাইলে দেখা গিয়েছিল। একই নম্বর থেকে পরিবারের কাছে মুক্তিপণের জন্য ফোন আসে এবং পরবর্তীতে অর্থ পরিশোধ করা হয়। তবে সেই সময় নম্বরটির মালিকানা নিশ্চিত করতে আমরা ব্যর্থ হই। কারণ সেই সিডিআর ডেটা আর নেই। নম্বরটি পুনর্বণ্টন করা হয়েছে এবং মূল নিবন্ধনের তথ্যও বিভ্রান্তিকর বলে মনে হয়েছে। ভুক্তভোগীদের জন্য এগুলো অত্যন্ত হতাশাজনক প্রতিবন্ধকতা।
২০২৪ সালের ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর আরেকটি নতুন সমস্যা দেখা দেয় উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, কিছু থানার পক্ষ থেকে জানানো হয় যে তাদের সংরক্ষিত রেকর্ড আগুনে পুড়ে গেছে। কিছু ক্ষেত্রে আমরা সন্দেহ করি যে এসব দাবির পেছনে সম্পূর্ণ সত্যতা নেই। তা সত্ত্বেও, পুরনো অভিযোগ বা মামলার নথি পেতে চাওয়া ভুক্তভোগীদের জন্য এটি একটি গুরুতর সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
‘ভয়ের পরিবেশ’
প্রতিবেদনে বলা হয়, যেসব ভিকটিম বেঁচে আছেন, তারা একেবারেই ভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছেন। যাদের জনসমক্ষে আনা হয়েছে, বিশেষ করে গত ফেব্রুয়ারিতে প্রধান উপদেষ্টার গোপন আটক কেন্দ্র পরিদর্শনের সময়, তাদের আমরা নিশ্চিত করেছি যে তারা পরবর্তী চাপ মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে এবং ভিকটিমরা সাহসিকতা প্রদর্শনও করেছেন। কিন্তু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ-ঘনিষ্ঠদের, ধারাবাহিক আক্রমণ ও অনলাইন হয়রানি তাদের ওপর মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি করেছে। যাদের শুরুতে সাহসী বলে মনে হচ্ছিল, তারাও পরে উল্লেখযোগ্য মানসিক কষ্টের কথা জানিয়েছেন। এছাড়া যেসব ভিকটিমকে জনসমক্ষে আনা হয়নি, তারা কখনও কখনও মনে করেন যে তাদের অবহেলা করা হয়েছে।
‘ভুক্তভোগীদের ভয় এখনও ব্যাপকভাবে বিরাজমান’ বলে মনে করছে কমিশন। প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশেষ করে যেসব ভুক্তভোগী এখনও সামনে আসেননি তাদের মধ্যে। আমাদের সাক্ষাৎকারে কান্না একটি নিয়মিত ও প্রত্যাশিত বিষয়। অনেকেই অনুরোধ করেন যেন অডিও রেকর্ডার বন্ধ রাখা হয়, আর অনেক সময় তারা এত আস্তে কথা বলেন যে, মনোযোগ দিয়ে শুনতে কষ্ট হয়। ২০২৫ সালের মাঝামাঝি, একজন জীবিত ভিকটিম অবশেষে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এত দেরিতে এসেছেন কেন, তাকে জিজ্ঞাসা করা হলে তার সোজাসাপ্টা উত্তর ছিল, আমি নিশ্চিত ছিলাম না কমিশনটা র’ দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে কিনা! এই ধরনের গভীর ভয় ও সন্দেহের পরিবেশই, আমাদের বিশ্বাস, বহু মামলা রিপোর্ট না হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কমিশনের সদস্যরা অজ্ঞাত পরিচয়ের কয়েকটি দেহ দাফনের তথ্য তদন্ত করতে বরিশালের একটি দূরবর্তী গ্রামে গিয়েছিলেন। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়েছিল, এলাকায় একটি বা দুটি গুমের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু কমিশনের সদস্যরা যখন উপস্থিত হন এবং জনগণের সঙ্গে কথা বলেন, তখন ওই একই গ্রামে নতুন করে পাঁচ থেকে সাতটি গুমের অভিযোগ সামনে আসে, যেগুলোর কোনোটি কমিশনের কাছে আগে রিপোর্ট করা হয়নি। কমিশনের সরাসরি উপস্থিতি ও কার্যক্রমের গুরুত্ব দেখে পরিবারগুলো সাহস পেয়ে এগিয়ে আসে। তবে এ ঘটনা ছিল শুধুমাত্র একটি গ্রামে। দেশে হাজার হাজার গ্রাম থাকলেও সময় ও সম্পদের সীমাবদ্ধতার কারণে আমরা এমন অভিযান ব্যাপকভাবে চালাতে পারিনি। তবু, এমন অভিজ্ঞতা আমাদের এই বিশ্বাস আরও দৃঢ় করে যে এখনও অনেক ভিকটিম রয়ে গেছেন যাদের কণ্ঠ স্তব্ধ হয়ে আছে—ভয় অথবা বিচ্ছিন্নতার কারণে।
গোপন আটক-কেন্দ্র ধ্বংস ও প্রমাণ লোপাট
নতুন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে নির্যাতন কেন্দ্র ‘হাসপাতাল’ ও ‘ক্লিনিক’ নামে পরিচিত দুটি গোপন কেন্দ্রের কাঠামো গুঁড়িয়ে দেওয়া এবং নির্যাতন যন্ত্রপাতি লুকানোর ভয়ংকর পরিকল্পনার চিত্র। র্যাব সদর দফতরের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি গোপন কেন্দ্র ‘টাস্ক ফোর্স ফর ইন্টারোগেশন (টিএফআই)’ বা ‘হাসপাতাল’ নামে পরিচিত। অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, সেখানে আটকে রাখা হয়েছিল নিখোঁজ ব্যারিস্টার মীর আহমদ বিন কাসেম আরমানকে। তার বর্ণনার সঙ্গে প্রাপ্ত স্থাপত্যগত বৈশিষ্ট্যের মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় হয়েছে, প্রাথমিক পর্যায়ে, বন্দিদশায় আরমানের পায়ের নিচে ঠান্ডা টাইলস থাকার বর্ণনার সঙ্গে বর্তমান সিমেন্টের খসখসে মেঝের অমিল দেখা যায়। তদন্তকারীরা ফ্লোরে গ্রিডের মতো দাগ খুঁজে পান, যা পুরনো টাইলসের অবশিষ্ট চিহ্ন বলে ধারণা করা হয়। এছাড়া একটি ছবিতে দেওয়ালের আলোর প্রতিবিম্ব দেখে আরমান অনুমান করেন, হয়তো সেখানেই আগে তার সেলের দরজা ছিল, যা পরে ইট-সিমেন্ট দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সহায়তায় ভেতরের ও বাইরের পরিমাপের পার্থক্য বিশ্লেষণ করে একটি লুকানো কক্ষ আবিষ্কৃত হয়– পুরোপুরি সিল করা (দরজা-জানালাবিহীন) একটি সেল। সেই সেলেই তিনি আট বছর আটকে ছিলেন।
প্রতিবদেনে বলা হয়, এসব ঘটনা নিশ্চিত করে যে, আগস্টের প্রথম সপ্তাহে মুক্তি দেওয়ার পরই দ্রুত সেখানে দেয়াল তুলে প্রমাণ মুছে ফেলার চেষ্টা চালানো হয়। এতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা, বিশেষত র্যাব ইন্টেলিজেন্স উইং-এর নতুন ও পুরনো কর্মকর্তারা, প্রতারণার মাধ্যমে দায় চাপা দেওয়ার অপরাধে জড়িয়ে পড়েছেন।
র্যাব সদর দফতরের ভেতরেই আরেকটি গোপন আটককেন্দ্র ছিল, যার নাম ছিল ‘ক্লিনিক’। এটি ‘গ্লাস হাউজ’ নামে একটি ভবনে অবস্থিত ছিল, যার বাইরের অংশ কাঁচে মোড়ানো। অনুসন্ধানের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, এখানে ছয়টি ছোট আটক সেল ছিল। কিন্তু এপ্রিল ২০২৫-এ পরিদর্শনের সময় দেখা যায়, এর কাঠামো অনেকটাই বদলে গেছে। দেয়াল ভেঙে বাথরুমের মতো ঘর বানানো হয়েছে এবং পুরনো সেল দরজাগুলো সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এই পুনর্গঠনের ধরন থেকে স্পষ্ট, এটি তড়িঘড়ি কোনও ব্যবস্থা ছিল না। বরং পরিকল্পিতভাবে নির্মাণ সামগ্রী ও জনবল ব্যবহার করে করা হয়েছে। একই সময়কালে ‘হাসপাতাল’ থেকে নির্যাতনের যন্ত্রপাতিও সরিয়ে ফেলা হয়, যার মধ্যে ছিল বৈদ্যুতিক শক চেয়ার, গরম পানির নির্যাতন যন্ত্র, চাবুক ও ছুরি জাতীয় ধারালো অস্ত্র।
প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, আগের অপরাধে জড়িত না থাকা কর্মকর্তারাও এখন গোপনীয়তা রক্ষায় সহায়তা করে অপরাধে জড়াচ্ছেন। এতে স্পষ্ট হয়, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে এক প্রজন্মের অপরাধ ঢাকতে পরবর্তী প্রজন্ম নিজেদেরও অপরাধী বানাচ্ছে। এই প্রবণতা শুধু তথ্য পাওয়া কঠিন করে তুলছে না, বরং বিচার প্রক্রিয়ার পথেও বড় বাধা তৈরি করছে।
মন্তব্য করুন